'' ‘মনের মানুষ’ কি? কার মনের মানুষ? সুনীল-গৌতম ‘মনের মানুষ’ বলতে কি বোঝেন? ... সিনেমায় কি বুঝানো... more '' ‘মনের মানুষ’ কি? কার মনের মানুষ? সুনীল-গৌতম ‘মনের মানুষ’ বলতে কি বোঝেন? ... সিনেমায় কি বুঝানো হল? লালন ফকির মনের মানুষের সঙ্গে মিলনের অপেক্ষায় থাকলেন, অথচ সুনীল-গৌতম দেখান যে মনের মানুষই তাকে দিয়ে কি সব কথাবার্তা বলায়। ‘মনের মানুষ’ কি আমাদের ‘অচেতন’? আমাদের ‘ইতিহাস’? সমাজ-উর্দ্ধ অলৌকিক সত্তা? ভাবাদর্শের উঁকিঝুঁকি? অস্পষ্ট থাকে ছবিতে। কিন্তু এই বই-ছবির সুনীল-গৌতমের ‘মনের মানুষ’ পরিস্ফুট এই বই-ছবিতে। কর্পোরেট পুঁজির যুগে তাদের মনের মানুষ হল কর্পোরেট ‘মনের মানুষ’। ইনকর্পোরেটেড। কর্পোরেটাইজড। কর্পোরেট বান্ধব। কর্পোরেট। কিরকম? মসৃন, মিষ্টি, কোমল, রহস্যময়, অনির্দিষ্ট,’অন্যরকম’, ‘আমাদের’, ‘ভালো’, ‘মানবতাবাদি’, ‘কুল’, ‘সেক্সি’।''
On the Politics of the film 'Moner Manush'. The film is about Lalon Fakir and the baul-fakir tradition of Bengal. But To what extent this film represents these this tradition and how? What is the cultural politics of this film ? How do we understand this film in a context of commodification and appropriation of the traditions and values of these radical praxises?
“Because nothing is less neutral, in the world of society, than the authoritative utterance of Being; the findings of science inevitably exert a political effect, which may not be that which the scholar intended.” – Pierre Bourdieu
“One could not be a calm, cool, and detached scientist while Negroes were lynched, murdered, and starved.” – W E B Du Bois }
১/ ‘ধর্ম’, জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তির চালু ধারণাগুলি নিত্য বা চিরন্তন নয়। অনিত্য, ‘আধুনিক’ ও পরিবর্তনশীল। যেমন, চিন্তা করেনঃ বাংলা-সংস্কৃত-সনাতন ট্র্যাডিশনে ‘বিজ্ঞান’ এর এক সময়ে অর্থ ছিলো বিশেষ মানসিক অবস্থাঃ ‘চেতন’, মনোভাব’, ‘সংস্কার’ ইত্যাদি। ধর্ম মানে ছিলো বস্তুর ধর্ম, প্রাণের ধর্ম, জীবের ধর্ম, মানুষের ধর্ম ইত্যাদি। ‘বিজ্ঞান’ নয় ‘প্রযুক্তি’। ধর্ম নয় রিলিজিয়ন। রিলিজিয়ন নয় ধর্ম বা দ্বীন বা উপাসনা।
২/ ‘বিজ্ঞান’-এর একটা কোনো উৎস বা কেন্দ্র নাই, নাই একটা মাত্র ধারণা বা একটা সরল রৈখিক ইতিহাস। শূন্য , বীজগণিত, আপেক্ষিকতার সূত্র কিংবা ইউনানী-আয়ুর্বেদী- কবিরাজী-হেকিমি চিকিৎসা/ ঔষধ কিংবা চাকা, নৌযান, জ্যোতির্বিজ্ঞান কিংবা কৃষি-খাদ্য-আবাস-পশুপালন কিংবা সুর-ছন্দ-রচনা-ভাষা-সমাজ-ইতিহাস-অর্থনীতির জ্ঞানের ইতিহাস দেখলেও সেসব আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু এসবই জ্ঞানের/বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের কিছু প্রকার উদাহরণ মাত্র।
৩/ দুনিয়ার সব অঞ্চলের সব রকম মানুষের বহুরকম জীবন-অভিজ্ঞতা-অনুশীলন-অনুসন্ধিৎসা-জ্ঞান-বিজ্ঞান-ধর্ম-সংস্কৃতির বিচিত্র-বহুরৈখিক ইতিহাস রচনা করছে। সেসব জ্ঞান-বিজ্ঞানের গ্রহণ-পরিগ্রহণ-দখল-আত্মীকরণ-স্থানান্তর-ভাষান্তর-রূপান্তর-পারস্পারিক প্রভাব-পরিগঠনের ইতিহাস আছে। পশ্চিম/ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ এই ইতিহাসের বড় এক পরিচ্ছেদ।
৪/ সামাজিক-সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা যেমনঃ উপাসনা/ধর্ম/দ্বীন/জীবনবিধান/জীবনব্যবস্থা্র বিকাশ/পরিবর্তন/বিবর্তনের বাঙময় ইতিহাসের মধ্যে যেমন ‘বিজ্ঞান’ অংশ, তেমনি এসব জ্ঞান/সংস্কৃতির বিকাশ-বিবর্তনের ক্ষেত্রে ‘বিজ্ঞান’ বা পদ্ধতি-পর্যালোচনামূলক জ্ঞান অনুশীলনের ভূমিকা আছে। ফলে, এটা ‘দুই’ হয়ে বিচ্ছিন্ন ইতিহাস হওয়ার আবশ্যকতা নাই বা ছিলো না প্রাক-পশ্চিমা ঔপনিবেশিক ‘আলোকায়ন’ প্রভাবের আগে। ‘বিজ্ঞান’ প্রতিষ্ঠান আকারে, ‘ধর্ম’ প্রতিষ্ঠান আকারে বিভিন্ন সমাজে হাজির হবার মধ্যে দিয়া এই ‘দুই’, দুই হয়ে উঠছে। ‘বিজ্ঞানবাদ’ এবং ‘ধর্ম’বাদ এই বিভাজন/ পৃথকীকরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার নাম। যা পরে একটা জোড়-বিপরীত(binary) হিসেবে চিন্তা এবং জ্ঞান জগতে রূপ ও প্রতিষ্ঠা পায়।
৫/ ‘ধর্ম’ বনাম ‘বিজ্ঞান’- একটা সাম্প্রতিক, ‘আলোকায়ন’ প্রভাবিত জোড়-বিপরীত(binary)। ঔপনিবেশিক আধুনিকতার ‘আলোকায়ন’ প্রভাবের আগে এরকম খাড়া খাড়ি জোড়-বিপরীত চর্চার সামাজিক ইতিহাস দেখা যায়না। আবার, ‘পশ্চিমা আধুনিকতা’ নিজেও দ্বন্দ্ব-বিরোধ/আভ্যন্তরীন টানা-পোড়েনবিহীন একহারা/মনোলিথিক ঘটনা না।
৬/ যুক্তি বনাম আবেগ দেখা, বস্তু বনাম ভাব দেখা, আলো বনাম অন্ধকার দেখা, পশ্চিম বনাম পূর্ব দেখা, সভ্যতা/বিজ্ঞানের ‘কেন্দ্র’, উৎস ইত্যাদির দাবী, শ্রেষ্ঠত্বের দাবী, ‘ধর্ম’র যৌক্তিক সামঞ্জস্যের (coherence)চাহিদা- সবি নানা সামাজিক- ঐতিহাসিক- প্রতিবেশগত অভিজ্ঞতা ও ভাব-বোঝাপড়ার প্রকাশ, কোনোটাই ‘মানবীয়’ জ্ঞান-অভিজ্ঞতা’র বাইরের বোঝাপড়া, ভাষ্য বা দৃষ্টিভঙ্গী না। একটা নোক্তাঃ ‘আস্তিক’-‘নাস্তিক’ জোড়-বিপরীত ধরে যে বিতর্ক চলে আজকাল, দুনিয়ায় ইতিহাসে ‘আধুনিক’ ‘ধর্মপ্রতিষ্ঠান’ হাজির হবার আগে, ‘ভারতবর্ষে’ এই দুইটা শব্দ ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করতো। তখন সেটা ছিলো প্রধানত জ্ঞান বা সত্য প্রমানের পদ্ধতির তর্ক। এটা রব বা উপাস্যর অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের তর্ক হয়া ওঠে ‘আধুনিক’ কালে।
৭/ জ্ঞান-বিজ্ঞান নিজে কোনো একহারা, সমসত্ত্ব, নিপাট, অবিসম্বাদিত মত-অভিজ্ঞতা-দৃষ্টিভঙ্গির ইতিহাস না। না- ধর্ম/বিজ্ঞানের একক কোনো কেন্দ্র/ব্যাখ্যা/ভাষ্য/অভিজ্ঞতা আছে, না ‘মানব সমাজ’ এর। জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধকদের/সমাজগুলার বহু মত ও ব্যাখ্যা আছে, আছে সামাজিক-সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা ও বোঝাপড়ার পার্থক্য, আছে এক সমাজ-সংস্কৃতিতে বিকশিত জ্ঞান-বিজ্ঞান, আরেক সমাজ-সংস্কৃতিতে গ্রহণ-বর্জন-রূপান্তর-প্রভাবক ভূমিকা। প্রায় কোনো ধর্ম-মতের প্রভাবাধীন সমাজই এমন লেনদেন- রূপান্তরের বাইরে নয়।
৮/ ধর্মকে ‘আদিবিজ্ঞান’ দাবী করা, ধর্মকে ‘বিজ্ঞান’সম্মত বা সর্বোচ্চ ‘বিজ্ঞান’ দাবী করা, ‘বিজ্ঞান’কে ‘ধর্ম’সম্মত হইতে বলা, ‘ধর্ম’সম্মত করার চেষ্টা করা… সবই সাম্প্রতিক, সংকোচনবাদী, ‘আধুনিক’ ‘বিজ্ঞানবাদী’ দাবী/চাহিদা। ‘ধর্ম’সমুহ এবং ‘বৈজ্ঞানিক জ্ঞান’ বিকাশের ইতিহাস এমন দাবী, চাহিদা এবং সমান্তরাল বিকাশের প্রমান দেয় না। অনেক ক্ষেত্রেই ‘ট্র্যাডিশনাল’ জ্ঞান/বিজ্ঞান/গল্প/ইতিহাস আর ‘ধর্মীয়’ জ্ঞানপ্রবাহের পার্থক্য রেখা টানা যায় না। ‘ধর্ম’ এবং ‘জ্ঞান-বিজ্ঞান’ এর একহারা/নিপাট/সমান্তরাল বিকাশের ইতিহাস নাই। দুইয়ের বহুমাত্রিক সম্পর্ক ‘দুই’ হওয়ার ইতিহাস থেকে শুরু, এখনো বিকাশমান।
৯/ নানা শাসনব্যবস্থায় অনেক দেশ-কালে অনেক সাধক ‘জ্ঞান-বিজ্ঞান’ এ বিপুল অবদান রেখেছেন, এটা যেমন ঐতিহাসিক সত্য, তেমনি কায়েমী মতের/স্বার্থের বাইরে মত প্রকাশ করায় জুলুমের শিকার হয়েছেন অনেক জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধক, এমন ঘটনা আছে- কিন্তু সেসবের কারণ ‘বিজ্ঞান বনাম ধর্ম’এর আজকের বিতর্কের অর্থে নয়, সেসব দেশ কালের রাজনৈতিক কারণ-প্রেক্ষিতে। স্বর্ণযুগ নস্টালজিয়া নিজেই ‘আধুনিক’তা প্রভাবিত অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা অনেক ক্ষেত্রেই পুনর্জাগরণবাদী (revivalist) এবং পরিচয়বাদী জুলুমশাহীর অঙ্কুরোদগম ঘটাতে ভূমিকা রাখে।
১০/ মজলুমের পাঠরীতি দিয়ে ইতিহাস পড়লে আমরা দেখতে পাবোঃ বিজ্ঞান-ধর্ম জোড়-বিপরীত প্রাচ্যবাদী/অরিয়েন্টালিস্ট বাইনারী। পশ্চিমা ঔপনিবেশিক বর্ণবাদী আধুনিক পুঁজিবাদ পুরুষতন্ত্রের জটিল সম্পর্কের মধ্যে বিকশিত প্রভাবশালী ‘বস্তু-ভাব’, ‘স্পিরিচ্যুয়াল’-‘ম্যাটেরিয়াল’, ‘আধ্যাত্মিকতা-বস্তুবাদিতা’ , ‘আবেগ- যুক্তি’, ‘প্রগতি-পশ্চাদপদতা’, ‘সভ্যতা- বর্বরতা’, ‘উন্নতি-অনুন্নতি’ জোড় বিপরীতের সাথে যুক্ত থাকা ‘ধর্ম- বিজ্ঞান’ বাইনারী দুনিয়া জোড়া ঔপনিবেশিক আর সাম্রাজ্যবাদী জুলুমশাহীর সাংস্কৃতিক-জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি, ওয়ার অন টেরর প্রকল্পেরও একটা ভিত্তি ও সেবক বাইনারি। আর এসব বাইনারি দেশে দেশে বর্ণবাদী, পরিচয়বাদী, পুরুষতান্ত্রিক-পুঁজিবাদী জুলু্মশাহীর সেবক বাইনারী।
১১/ তাই আমাদের ভাবা দরকারঃ কীভাবে, কতভাবে, কত প্রক্রিয়ায় ‘ধর্ম’ এবং ‘বিজ্ঞান’ নামের ‘আধুনিক’ প্রতিষ্ঠানগুলি সমাজে হাজির হইলো বা ‘ধর্ম’ এবং ‘বিজ্ঞান’ ‘আধুনিক’ সকল বুঝ-ভাষা-ভঙ্গি-ব্যাখ্যা-অনুশীলন-রীতি-নীতি বদ্ধ বা প্রভাবিত হয়ে উঠলো কখন, কীভাবে, কি সব প্রক্রিয়ায়? পশ্চিমা-ঔপনিবেশিক-বর্ণবাদী আধুনিকতা- শিল্পবিপ্লব- পুঁজিবাদ-গ্লোবালাইজেশন, ধর্ম এবং বিজ্ঞানের এই প্রাতিষ্ঠানিকতা প্রাপ্তিতে কীভাবে কতখানি ভূমিকা রাখলো। ‘ধর্ম’ ও ‘বিজ্ঞান’ আধুনিক প্রতিষ্ঠানের সুবিধা-সমস্যা-স্বরুপ বোঝার উপায় কি? জোড়-বিপরীত(binary) মডেলের চিন্তা-পদ্ধতি দিয়ে কি সমাজ-ইতিহাসের জটিল, বহুমাত্রিক, বহুরৈখিক গঠন, অভিজ্ঞতা, পরিচলন-পরিবর্তন আদৌ সম্যক বোঝা সম্ভব? না কি জোড়-বিপরীত ভিত্তিক চিন্তা-পদ্ধতির বাইরে যাওয়া জরুরি? বর্ণবাদ, পুরুষতন্ত্র, পরিচয়বাদ, শ্রেণী জুলুম, পরিবেশ এবং জলবায়ু সংকট- এসব অভিজ্ঞতা কি ‘ধর্ম’ ও ‘বিজ্ঞান’ প্রতিষ্ঠানের স্বরুপ বুঝতে সাহায্য করে?
১২/ পশ্চিমা ঔপনিবেশিক বর্ণবাদী পুঁজিবাদ, পুরুষতন্ত্র, জাতি/পরিচয়বাদ, রাষ্ট্রবাদ সব কিছু মিলে যে জুলুমশাহী, জোড়-বিপরীত চিন্তা মডেল এই জুলুমশাহী’র প্রধানতম নিয়ামক। তাহলে এই জুলুমশাহীর ক্রিটিক/পর্যালোচনা করতে সক্ষম ভাব-জ্ঞান-অনুশীলন-সাধনা কেমন সাধনা? সে সাধনার প্রক্রিয়ায় সব সমাজ যদি অংশ নেয়, তাহলে ‘বিজ্ঞান’ এবং ‘ধর্ম’ গুলার আজকের কায়েমী বুঝ-অনুশীলন কি আর বহাল থাকবে? নতুন এক অভিজ্ঞতার পর্বে দুনিয়া প্রবেশ করবে না?
তাহলে আলাপটা বিজ্ঞান বনাম ধর্ম নয়। প্রশ্ন করতে হবে, বিজ্ঞান ও ধর্মের ঔপনিবেশিক- সাম্রাজ্যবাদী-বর্ণবাদী-পুরুষতান্ত্রিক জ্ঞান-প্রতিষ্ঠানকে, এর ধ্যানধারণা- অনুশীলনকে। সাধনা করতে হবে বিজ্ঞান এবং ধর্মের ধ্যান- ধারণা-অনুশীলনের বিউপনিবেশায়নের। বিউপনিবেশায়ন কোনো স্বর্ণালী অতীত, স্বর্ণযুগ, গর্বের অতীত, বিশুদ্ধ অতীত ইত্যাদিতে ফেরা বা ফিরিয়ে আনার সাধনা না, ওসবে ফেরা যায় না বা ফেরানো যায় না। এমন ফেরা বা ফেরানোর কল্পনা নিজেই একটা সমস্যাঃ আধুনিকতার অভিজ্ঞতার সংগে সম্পর্কিত। বিউপনিবেশায়ন এই কল্পনার ঐতিহাসিক-সামাজিক উৎসকে বোঝা, চলমান জুলুমশাহীকে বোঝা, জুলুমশাহীর জ্ঞানপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়াকে বোঝা এবং জুলুমশাহীর জ্ঞান- বিজ্ঞান-ধর্ম-সমাজ-জীবনব্যবস্থা থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করার বহুমাত্রিক-বহুরৈখিক সাধনার মধ্যে দিয়ে জ্ঞান-সমাজ-ইতিহাসের নতুন পর্ব হাজির করতে থাকা, বর্তমানে।
এখনো এই দেশে এমন অনেক মানুষ আছি আমরা, যারা সাবানের মোড়ক পথে পড়ে থাকতে দেখলেও তুলে পরিষ্কার করে সে... more এখনো এই দেশে এমন অনেক মানুষ আছি আমরা, যারা সাবানের মোড়ক পথে পড়ে থাকতে দেখলেও তুলে পরিষ্কার করে সেটাকে পবিত্র জ্ঞানে চুমু খাই, যদি তাতে ‘আরবী’ হরফে কিছু লেখা থাকে- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ – রাসুল এর পবিত্র কোনো কালাম বা তাদের সম্পর্কে কোনো বাক্য/শব্দ লেখা আছে !’ – এমন ভাবনা থেকে এই কাজ করি আমরা। ‘আরবী’ ভাষা, ‘আরব’ এবং ‘ইসলাম’ সম্পর্কে আমাদের বহুমাত্রিক জ্ঞান- অজ্ঞানের একটা প্রকাশ হিসেবে এমন ঘটনাকে চিহ্নিত করতে পারি। আমাদের সমাজে অতি সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত ‘আরব’ , ‘জাহেলিয়া ‘ আর ‘ইসলাম’ সম্পর্কে– ‘ঐতিহাসিক জ্ঞান’এর প্রধান রসদগুলারমধ্যে আছে কোরান , বহুরকম হাদিস, কিছু হামদ– নাত, কিছু সিরাতুন্নবী; আছে ‘বিষাদ সিন্ধুর’ কারবালা– ফোরাত বর্ণনা, প্রাচীন পর্যটক আর মুসাফির/সুফি/ফকির পর্যটকদের বর্ণনার বাংলা রূপান্তর, আর ইরাক, পারস্য অঞ্চলের মনিষী–সাধকদের রচনা/কাহিনীর নানা রুপ ; আছে মাদ্রাসা ধরণের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আরবী চর্চা থেকে সমাজে যা যা কথ্য এবং লেখ্য রুপে এবং স্থানীয়– বৈশ্বিক প্রচার মাধ্যমে বাংলা বা অন্যান্য স্থানীয় ভাষায় যা যা আসে । এর বাইরে , কথিত ‘সেক্যুলার’ শিক্ষা/জ্ঞান ব্যবস্থায় / বাংলা ভাষায় ফিলিপ কে হিটি( Philip Khuri Hitti)র History of the Arabs এর প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ ‘র করা বাংলা অনুবাদ প্রথমে ‘ আরব জাতির ইতিকথা’ নামে এবং পরে ‘ আরব জাতির ইতিহাস নামে, ১৯৫৯ সাল থেকে বাংলাদেশে, বাংলা ভাষায় ‘আরব জাতি’র ইতিহাস বোঝার প্রধানতম একটা বইয়ে পরিনত হয়। হিটি এই বাংলা সংস্করণ প্রকাশের ভূমিকা লিখেন। বাংলা বইয়ের ‘অগ্র লেখা ‘ লিখে দেন ঢাকার মাদ্রাসা–ই–আলিয়ার মওলানা মুস্তাফিজুর রহমান, ১৯৫৮ সালে। সেকালের ইসলামিক একাডেমি প্রকাশ করে এই সংস্করণ। এর বাইরে ৯/১১ পর্যন্ত বাংলায় ও বাংলাদেশে আরব, জাহেলিয়া এবং ইসলাম সম্পর্কে ‘জনপ্রিয়’ তেমন কোনো ইতিহাস বই নাই। । ৯/১১ এর পর সারা দুনিয়াতেই নতুন করে ইসলাম, আরব, মধ্যপ্রাচ্য, আব্রাহামিক ধর্মগুলার ইতিহাস এবং ধর্ম অধ্যয়ন শাস্ত্রের বিপুল পাঠ, অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা শুরু হয়। বাংলাদেশে ও বাংলাভাষাতে ইসলাম প্রসঙ্গে ইংরেজী ভাষা, পশ্চিম ও জনপ্রিয় পাঠ জগতের লেখক ও ইতিহাসকারদের জনপ্রিয় ধাচের রচনা অনুদিত হইতে শুরু করে। বাংলাভাষী/ বাংলাদেশের লেখকদের নিজস্ব রচনা লক্ষ্যনীয়ভাবে হাতে গোনা । তার দুই একটা বাদে বাকীগুলি অনেকেরই জরুরতের বিবেচনায় পাঠ তালিকা বহির্ভূত থাকবে। ৯/১১ এর আগেও, ৮০/৯০/০০ দশকে বিভিন্ন মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন অঞ্চলের সরকারী–বেসরকারী প্রকল্প সহযোগিতায় অনেক ‘ইসলামি লিটারেচার’ বাংলায় অনুবাদ হয়, যার ধারা এখনো প্রবহমান। কিন্তু সেসব অনুবাদের তালিকায় ‘পদ্ধতিগত ইতিহাস চর্চা’র জায়গা থেকে রচিত আরব/জাহেলিয়া/ইসলামের ইতিহাসের বই/আলাপ তেমন লক্ষ্য করা যায় না। কেন নাই– সেটার সামাজিক–ঐতিহাসিক পর্যালোচনা এই আলোচনার লক্ষ্য না। ‘পদ্ধতিগত ইতিহাসচর্চা’ই এখানে প্রশ্ন।
'' ‘মনের মানুষ’ কি? কার মনের মানুষ? সুনীল-গৌতম ‘মনের মানুষ’ বলতে কি বোঝেন? ... সিনেমায় কি বুঝানো... more '' ‘মনের মানুষ’ কি? কার মনের মানুষ? সুনীল-গৌতম ‘মনের মানুষ’ বলতে কি বোঝেন? ... সিনেমায় কি বুঝানো হল? লালন ফকির মনের মানুষের সঙ্গে মিলনের অপেক্ষায় থাকলেন, অথচ সুনীল-গৌতম দেখান যে মনের মানুষই তাকে দিয়ে কি সব কথাবার্তা বলায়। ‘মনের মানুষ’ কি আমাদের ‘অচেতন’? আমাদের ‘ইতিহাস’? সমাজ-উর্দ্ধ অলৌকিক সত্তা? ভাবাদর্শের উঁকিঝুঁকি? অস্পষ্ট থাকে ছবিতে। কিন্তু এই বই-ছবির সুনীল-গৌতমের ‘মনের মানুষ’ পরিস্ফুট এই বই-ছবিতে। কর্পোরেট পুঁজির যুগে তাদের মনের মানুষ হল কর্পোরেট ‘মনের মানুষ’। ইনকর্পোরেটেড। কর্পোরেটাইজড। কর্পোরেট বান্ধব। কর্পোরেট। কিরকম? মসৃন, মিষ্টি, কোমল, রহস্যময়, অনির্দিষ্ট,’অন্যরকম’, ‘আমাদের’, ‘ভালো’, ‘মানবতাবাদি’, ‘কুল’, ‘সেক্সি’।''
On the Politics of the film 'Moner Manush'. The film is about Lalon Fakir and the baul-fakir tradition of Bengal. But To what extent this film represents these this tradition and how? What is the cultural politics of this film ? How do we understand this film in a context of commodification and appropriation of the traditions and values of these radical praxises?
“Because nothing is less neutral, in the world of society, than the authoritative utterance of Being; the findings of science inevitably exert a political effect, which may not be that which the scholar intended.” – Pierre Bourdieu
“One could not be a calm, cool, and detached scientist while Negroes were lynched, murdered, and starved.” – W E B Du Bois }
১/ ‘ধর্ম’, জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তির চালু ধারণাগুলি নিত্য বা চিরন্তন নয়। অনিত্য, ‘আধুনিক’ ও পরিবর্তনশীল। যেমন, চিন্তা করেনঃ বাংলা-সংস্কৃত-সনাতন ট্র্যাডিশনে ‘বিজ্ঞান’ এর এক সময়ে অর্থ ছিলো বিশেষ মানসিক অবস্থাঃ ‘চেতন’, মনোভাব’, ‘সংস্কার’ ইত্যাদি। ধর্ম মানে ছিলো বস্তুর ধর্ম, প্রাণের ধর্ম, জীবের ধর্ম, মানুষের ধর্ম ইত্যাদি। ‘বিজ্ঞান’ নয় ‘প্রযুক্তি’। ধর্ম নয় রিলিজিয়ন। রিলিজিয়ন নয় ধর্ম বা দ্বীন বা উপাসনা।
২/ ‘বিজ্ঞান’-এর একটা কোনো উৎস বা কেন্দ্র নাই, নাই একটা মাত্র ধারণা বা একটা সরল রৈখিক ইতিহাস। শূন্য , বীজগণিত, আপেক্ষিকতার সূত্র কিংবা ইউনানী-আয়ুর্বেদী- কবিরাজী-হেকিমি চিকিৎসা/ ঔষধ কিংবা চাকা, নৌযান, জ্যোতির্বিজ্ঞান কিংবা কৃষি-খাদ্য-আবাস-পশুপালন কিংবা সুর-ছন্দ-রচনা-ভাষা-সমাজ-ইতিহাস-অর্থনীতির জ্ঞানের ইতিহাস দেখলেও সেসব আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু এসবই জ্ঞানের/বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের কিছু প্রকার উদাহরণ মাত্র।
৩/ দুনিয়ার সব অঞ্চলের সব রকম মানুষের বহুরকম জীবন-অভিজ্ঞতা-অনুশীলন-অনুসন্ধিৎসা-জ্ঞান-বিজ্ঞান-ধর্ম-সংস্কৃতির বিচিত্র-বহুরৈখিক ইতিহাস রচনা করছে। সেসব জ্ঞান-বিজ্ঞানের গ্রহণ-পরিগ্রহণ-দখল-আত্মীকরণ-স্থানান্তর-ভাষান্তর-রূপান্তর-পারস্পারিক প্রভাব-পরিগঠনের ইতিহাস আছে। পশ্চিম/ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ এই ইতিহাসের বড় এক পরিচ্ছেদ।
৪/ সামাজিক-সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা যেমনঃ উপাসনা/ধর্ম/দ্বীন/জীবনবিধান/জীবনব্যবস্থা্র বিকাশ/পরিবর্তন/বিবর্তনের বাঙময় ইতিহাসের মধ্যে যেমন ‘বিজ্ঞান’ অংশ, তেমনি এসব জ্ঞান/সংস্কৃতির বিকাশ-বিবর্তনের ক্ষেত্রে ‘বিজ্ঞান’ বা পদ্ধতি-পর্যালোচনামূলক জ্ঞান অনুশীলনের ভূমিকা আছে। ফলে, এটা ‘দুই’ হয়ে বিচ্ছিন্ন ইতিহাস হওয়ার আবশ্যকতা নাই বা ছিলো না প্রাক-পশ্চিমা ঔপনিবেশিক ‘আলোকায়ন’ প্রভাবের আগে। ‘বিজ্ঞান’ প্রতিষ্ঠান আকারে, ‘ধর্ম’ প্রতিষ্ঠান আকারে বিভিন্ন সমাজে হাজির হবার মধ্যে দিয়া এই ‘দুই’, দুই হয়ে উঠছে। ‘বিজ্ঞানবাদ’ এবং ‘ধর্ম’বাদ এই বিভাজন/ পৃথকীকরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার নাম। যা পরে একটা জোড়-বিপরীত(binary) হিসেবে চিন্তা এবং জ্ঞান জগতে রূপ ও প্রতিষ্ঠা পায়।
৫/ ‘ধর্ম’ বনাম ‘বিজ্ঞান’- একটা সাম্প্রতিক, ‘আলোকায়ন’ প্রভাবিত জোড়-বিপরীত(binary)। ঔপনিবেশিক আধুনিকতার ‘আলোকায়ন’ প্রভাবের আগে এরকম খাড়া খাড়ি জোড়-বিপরীত চর্চার সামাজিক ইতিহাস দেখা যায়না। আবার, ‘পশ্চিমা আধুনিকতা’ নিজেও দ্বন্দ্ব-বিরোধ/আভ্যন্তরীন টানা-পোড়েনবিহীন একহারা/মনোলিথিক ঘটনা না।
৬/ যুক্তি বনাম আবেগ দেখা, বস্তু বনাম ভাব দেখা, আলো বনাম অন্ধকার দেখা, পশ্চিম বনাম পূর্ব দেখা, সভ্যতা/বিজ্ঞানের ‘কেন্দ্র’, উৎস ইত্যাদির দাবী, শ্রেষ্ঠত্বের দাবী, ‘ধর্ম’র যৌক্তিক সামঞ্জস্যের (coherence)চাহিদা- সবি নানা সামাজিক- ঐতিহাসিক- প্রতিবেশগত অভিজ্ঞতা ও ভাব-বোঝাপড়ার প্রকাশ, কোনোটাই ‘মানবীয়’ জ্ঞান-অভিজ্ঞতা’র বাইরের বোঝাপড়া, ভাষ্য বা দৃষ্টিভঙ্গী না। একটা নোক্তাঃ ‘আস্তিক’-‘নাস্তিক’ জোড়-বিপরীত ধরে যে বিতর্ক চলে আজকাল, দুনিয়ায় ইতিহাসে ‘আধুনিক’ ‘ধর্মপ্রতিষ্ঠান’ হাজির হবার আগে, ‘ভারতবর্ষে’ এই দুইটা শব্দ ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করতো। তখন সেটা ছিলো প্রধানত জ্ঞান বা সত্য প্রমানের পদ্ধতির তর্ক। এটা রব বা উপাস্যর অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের তর্ক হয়া ওঠে ‘আধুনিক’ কালে।
৭/ জ্ঞান-বিজ্ঞান নিজে কোনো একহারা, সমসত্ত্ব, নিপাট, অবিসম্বাদিত মত-অভিজ্ঞতা-দৃষ্টিভঙ্গির ইতিহাস না। না- ধর্ম/বিজ্ঞানের একক কোনো কেন্দ্র/ব্যাখ্যা/ভাষ্য/অভিজ্ঞতা আছে, না ‘মানব সমাজ’ এর। জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধকদের/সমাজগুলার বহু মত ও ব্যাখ্যা আছে, আছে সামাজিক-সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা ও বোঝাপড়ার পার্থক্য, আছে এক সমাজ-সংস্কৃতিতে বিকশিত জ্ঞান-বিজ্ঞান, আরেক সমাজ-সংস্কৃতিতে গ্রহণ-বর্জন-রূপান্তর-প্রভাবক ভূমিকা। প্রায় কোনো ধর্ম-মতের প্রভাবাধীন সমাজই এমন লেনদেন- রূপান্তরের বাইরে নয়।
৮/ ধর্মকে ‘আদিবিজ্ঞান’ দাবী করা, ধর্মকে ‘বিজ্ঞান’সম্মত বা সর্বোচ্চ ‘বিজ্ঞান’ দাবী করা, ‘বিজ্ঞান’কে ‘ধর্ম’সম্মত হইতে বলা, ‘ধর্ম’সম্মত করার চেষ্টা করা… সবই সাম্প্রতিক, সংকোচনবাদী, ‘আধুনিক’ ‘বিজ্ঞানবাদী’ দাবী/চাহিদা। ‘ধর্ম’সমুহ এবং ‘বৈজ্ঞানিক জ্ঞান’ বিকাশের ইতিহাস এমন দাবী, চাহিদা এবং সমান্তরাল বিকাশের প্রমান দেয় না। অনেক ক্ষেত্রেই ‘ট্র্যাডিশনাল’ জ্ঞান/বিজ্ঞান/গল্প/ইতিহাস আর ‘ধর্মীয়’ জ্ঞানপ্রবাহের পার্থক্য রেখা টানা যায় না। ‘ধর্ম’ এবং ‘জ্ঞান-বিজ্ঞান’ এর একহারা/নিপাট/সমান্তরাল বিকাশের ইতিহাস নাই। দুইয়ের বহুমাত্রিক সম্পর্ক ‘দুই’ হওয়ার ইতিহাস থেকে শুরু, এখনো বিকাশমান।
৯/ নানা শাসনব্যবস্থায় অনেক দেশ-কালে অনেক সাধক ‘জ্ঞান-বিজ্ঞান’ এ বিপুল অবদান রেখেছেন, এটা যেমন ঐতিহাসিক সত্য, তেমনি কায়েমী মতের/স্বার্থের বাইরে মত প্রকাশ করায় জুলুমের শিকার হয়েছেন অনেক জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধক, এমন ঘটনা আছে- কিন্তু সেসবের কারণ ‘বিজ্ঞান বনাম ধর্ম’এর আজকের বিতর্কের অর্থে নয়, সেসব দেশ কালের রাজনৈতিক কারণ-প্রেক্ষিতে। স্বর্ণযুগ নস্টালজিয়া নিজেই ‘আধুনিক’তা প্রভাবিত অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা অনেক ক্ষেত্রেই পুনর্জাগরণবাদী (revivalist) এবং পরিচয়বাদী জুলুমশাহীর অঙ্কুরোদগম ঘটাতে ভূমিকা রাখে।
১০/ মজলুমের পাঠরীতি দিয়ে ইতিহাস পড়লে আমরা দেখতে পাবোঃ বিজ্ঞান-ধর্ম জোড়-বিপরীত প্রাচ্যবাদী/অরিয়েন্টালিস্ট বাইনারী। পশ্চিমা ঔপনিবেশিক বর্ণবাদী আধুনিক পুঁজিবাদ পুরুষতন্ত্রের জটিল সম্পর্কের মধ্যে বিকশিত প্রভাবশালী ‘বস্তু-ভাব’, ‘স্পিরিচ্যুয়াল’-‘ম্যাটেরিয়াল’, ‘আধ্যাত্মিকতা-বস্তুবাদিতা’ , ‘আবেগ- যুক্তি’, ‘প্রগতি-পশ্চাদপদতা’, ‘সভ্যতা- বর্বরতা’, ‘উন্নতি-অনুন্নতি’ জোড় বিপরীতের সাথে যুক্ত থাকা ‘ধর্ম- বিজ্ঞান’ বাইনারী দুনিয়া জোড়া ঔপনিবেশিক আর সাম্রাজ্যবাদী জুলুমশাহীর সাংস্কৃতিক-জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি, ওয়ার অন টেরর প্রকল্পেরও একটা ভিত্তি ও সেবক বাইনারি। আর এসব বাইনারি দেশে দেশে বর্ণবাদী, পরিচয়বাদী, পুরুষতান্ত্রিক-পুঁজিবাদী জুলু্মশাহীর সেবক বাইনারী।
১১/ তাই আমাদের ভাবা দরকারঃ কীভাবে, কতভাবে, কত প্রক্রিয়ায় ‘ধর্ম’ এবং ‘বিজ্ঞান’ নামের ‘আধুনিক’ প্রতিষ্ঠানগুলি সমাজে হাজির হইলো বা ‘ধর্ম’ এবং ‘বিজ্ঞান’ ‘আধুনিক’ সকল বুঝ-ভাষা-ভঙ্গি-ব্যাখ্যা-অনুশীলন-রীতি-নীতি বদ্ধ বা প্রভাবিত হয়ে উঠলো কখন, কীভাবে, কি সব প্রক্রিয়ায়? পশ্চিমা-ঔপনিবেশিক-বর্ণবাদী আধুনিকতা- শিল্পবিপ্লব- পুঁজিবাদ-গ্লোবালাইজেশন, ধর্ম এবং বিজ্ঞানের এই প্রাতিষ্ঠানিকতা প্রাপ্তিতে কীভাবে কতখানি ভূমিকা রাখলো। ‘ধর্ম’ ও ‘বিজ্ঞান’ আধুনিক প্রতিষ্ঠানের সুবিধা-সমস্যা-স্বরুপ বোঝার উপায় কি? জোড়-বিপরীত(binary) মডেলের চিন্তা-পদ্ধতি দিয়ে কি সমাজ-ইতিহাসের জটিল, বহুমাত্রিক, বহুরৈখিক গঠন, অভিজ্ঞতা, পরিচলন-পরিবর্তন আদৌ সম্যক বোঝা সম্ভব? না কি জোড়-বিপরীত ভিত্তিক চিন্তা-পদ্ধতির বাইরে যাওয়া জরুরি? বর্ণবাদ, পুরুষতন্ত্র, পরিচয়বাদ, শ্রেণী জুলুম, পরিবেশ এবং জলবায়ু সংকট- এসব অভিজ্ঞতা কি ‘ধর্ম’ ও ‘বিজ্ঞান’ প্রতিষ্ঠানের স্বরুপ বুঝতে সাহায্য করে?
১২/ পশ্চিমা ঔপনিবেশিক বর্ণবাদী পুঁজিবাদ, পুরুষতন্ত্র, জাতি/পরিচয়বাদ, রাষ্ট্রবাদ সব কিছু মিলে যে জুলুমশাহী, জোড়-বিপরীত চিন্তা মডেল এই জুলুমশাহী’র প্রধানতম নিয়ামক। তাহলে এই জুলুমশাহীর ক্রিটিক/পর্যালোচনা করতে সক্ষম ভাব-জ্ঞান-অনুশীলন-সাধনা কেমন সাধনা? সে সাধনার প্রক্রিয়ায় সব সমাজ যদি অংশ নেয়, তাহলে ‘বিজ্ঞান’ এবং ‘ধর্ম’ গুলার আজকের কায়েমী বুঝ-অনুশীলন কি আর বহাল থাকবে? নতুন এক অভিজ্ঞতার পর্বে দুনিয়া প্রবেশ করবে না?
তাহলে আলাপটা বিজ্ঞান বনাম ধর্ম নয়। প্রশ্ন করতে হবে, বিজ্ঞান ও ধর্মের ঔপনিবেশিক- সাম্রাজ্যবাদী-বর্ণবাদী-পুরুষতান্ত্রিক জ্ঞান-প্রতিষ্ঠানকে, এর ধ্যানধারণা- অনুশীলনকে। সাধনা করতে হবে বিজ্ঞান এবং ধর্মের ধ্যান- ধারণা-অনুশীলনের বিউপনিবেশায়নের। বিউপনিবেশায়ন কোনো স্বর্ণালী অতীত, স্বর্ণযুগ, গর্বের অতীত, বিশুদ্ধ অতীত ইত্যাদিতে ফেরা বা ফিরিয়ে আনার সাধনা না, ওসবে ফেরা যায় না বা ফেরানো যায় না। এমন ফেরা বা ফেরানোর কল্পনা নিজেই একটা সমস্যাঃ আধুনিকতার অভিজ্ঞতার সংগে সম্পর্কিত। বিউপনিবেশায়ন এই কল্পনার ঐতিহাসিক-সামাজিক উৎসকে বোঝা, চলমান জুলুমশাহীকে বোঝা, জুলুমশাহীর জ্ঞানপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়াকে বোঝা এবং জুলুমশাহীর জ্ঞান- বিজ্ঞান-ধর্ম-সমাজ-জীবনব্যবস্থা থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করার বহুমাত্রিক-বহুরৈখিক সাধনার মধ্যে দিয়ে জ্ঞান-সমাজ-ইতিহাসের নতুন পর্ব হাজির করতে থাকা, বর্তমানে।
এখনো এই দেশে এমন অনেক মানুষ আছি আমরা, যারা সাবানের মোড়ক পথে পড়ে থাকতে দেখলেও তুলে পরিষ্কার করে সে... more এখনো এই দেশে এমন অনেক মানুষ আছি আমরা, যারা সাবানের মোড়ক পথে পড়ে থাকতে দেখলেও তুলে পরিষ্কার করে সেটাকে পবিত্র জ্ঞানে চুমু খাই, যদি তাতে ‘আরবী’ হরফে কিছু লেখা থাকে- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ – রাসুল এর পবিত্র কোনো কালাম বা তাদের সম্পর্কে কোনো বাক্য/শব্দ লেখা আছে !’ – এমন ভাবনা থেকে এই কাজ করি আমরা। ‘আরবী’ ভাষা, ‘আরব’ এবং ‘ইসলাম’ সম্পর্কে আমাদের বহুমাত্রিক জ্ঞান- অজ্ঞানের একটা প্রকাশ হিসেবে এমন ঘটনাকে চিহ্নিত করতে পারি। আমাদের সমাজে অতি সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত ‘আরব’ , ‘জাহেলিয়া ‘ আর ‘ইসলাম’ সম্পর্কে– ‘ঐতিহাসিক জ্ঞান’এর প্রধান রসদগুলারমধ্যে আছে কোরান , বহুরকম হাদিস, কিছু হামদ– নাত, কিছু সিরাতুন্নবী; আছে ‘বিষাদ সিন্ধুর’ কারবালা– ফোরাত বর্ণনা, প্রাচীন পর্যটক আর মুসাফির/সুফি/ফকির পর্যটকদের বর্ণনার বাংলা রূপান্তর, আর ইরাক, পারস্য অঞ্চলের মনিষী–সাধকদের রচনা/কাহিনীর নানা রুপ ; আছে মাদ্রাসা ধরণের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আরবী চর্চা থেকে সমাজে যা যা কথ্য এবং লেখ্য রুপে এবং স্থানীয়– বৈশ্বিক প্রচার মাধ্যমে বাংলা বা অন্যান্য স্থানীয় ভাষায় যা যা আসে । এর বাইরে , কথিত ‘সেক্যুলার’ শিক্ষা/জ্ঞান ব্যবস্থায় / বাংলা ভাষায় ফিলিপ কে হিটি( Philip Khuri Hitti)র History of the Arabs এর প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ ‘র করা বাংলা অনুবাদ প্রথমে ‘ আরব জাতির ইতিকথা’ নামে এবং পরে ‘ আরব জাতির ইতিহাস নামে, ১৯৫৯ সাল থেকে বাংলাদেশে, বাংলা ভাষায় ‘আরব জাতি’র ইতিহাস বোঝার প্রধানতম একটা বইয়ে পরিনত হয়। হিটি এই বাংলা সংস্করণ প্রকাশের ভূমিকা লিখেন। বাংলা বইয়ের ‘অগ্র লেখা ‘ লিখে দেন ঢাকার মাদ্রাসা–ই–আলিয়ার মওলানা মুস্তাফিজুর রহমান, ১৯৫৮ সালে। সেকালের ইসলামিক একাডেমি প্রকাশ করে এই সংস্করণ। এর বাইরে ৯/১১ পর্যন্ত বাংলায় ও বাংলাদেশে আরব, জাহেলিয়া এবং ইসলাম সম্পর্কে ‘জনপ্রিয়’ তেমন কোনো ইতিহাস বই নাই। । ৯/১১ এর পর সারা দুনিয়াতেই নতুন করে ইসলাম, আরব, মধ্যপ্রাচ্য, আব্রাহামিক ধর্মগুলার ইতিহাস এবং ধর্ম অধ্যয়ন শাস্ত্রের বিপুল পাঠ, অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা শুরু হয়। বাংলাদেশে ও বাংলাভাষাতে ইসলাম প্রসঙ্গে ইংরেজী ভাষা, পশ্চিম ও জনপ্রিয় পাঠ জগতের লেখক ও ইতিহাসকারদের জনপ্রিয় ধাচের রচনা অনুদিত হইতে শুরু করে। বাংলাভাষী/ বাংলাদেশের লেখকদের নিজস্ব রচনা লক্ষ্যনীয়ভাবে হাতে গোনা । তার দুই একটা বাদে বাকীগুলি অনেকেরই জরুরতের বিবেচনায় পাঠ তালিকা বহির্ভূত থাকবে। ৯/১১ এর আগেও, ৮০/৯০/০০ দশকে বিভিন্ন মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন অঞ্চলের সরকারী–বেসরকারী প্রকল্প সহযোগিতায় অনেক ‘ইসলামি লিটারেচার’ বাংলায় অনুবাদ হয়, যার ধারা এখনো প্রবহমান। কিন্তু সেসব অনুবাদের তালিকায় ‘পদ্ধতিগত ইতিহাস চর্চা’র জায়গা থেকে রচিত আরব/জাহেলিয়া/ইসলামের ইতিহাসের বই/আলাপ তেমন লক্ষ্য করা যায় না। কেন নাই– সেটার সামাজিক–ঐতিহাসিক পর্যালোচনা এই আলোচনার লক্ষ্য না। ‘পদ্ধতিগত ইতিহাসচর্চা’ই এখানে প্রশ্ন।
Uploads
Papers by Arup Rahee
On the Politics of the film 'Moner Manush'. The film is about Lalon Fakir and the baul-fakir tradition of Bengal. But To what extent this film represents these this tradition and how? What is the cultural politics of this film ? How do we understand this film in a context of commodification and appropriation of the traditions and values of these radical praxises?
Teaching Documents by Arup Rahee
{ “কী করো শ্বশুর লেখাজোখা, মেঘেই দেখ জলের রেখা’’- খনা
“Because nothing is less neutral, in the world of society, than the authoritative utterance of Being; the findings of science inevitably exert a political effect, which may not be that which the scholar intended.” – Pierre Bourdieu
“One could not be a calm, cool, and detached scientist while Negroes were lynched, murdered, and starved.” – W E B Du Bois }
১/ ‘ধর্ম’, জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তির চালু ধারণাগুলি নিত্য বা চিরন্তন নয়। অনিত্য, ‘আধুনিক’ ও পরিবর্তনশীল। যেমন, চিন্তা করেনঃ বাংলা-সংস্কৃত-সনাতন ট্র্যাডিশনে ‘বিজ্ঞান’ এর এক সময়ে অর্থ ছিলো বিশেষ মানসিক অবস্থাঃ ‘চেতন’, মনোভাব’, ‘সংস্কার’ ইত্যাদি। ধর্ম মানে ছিলো বস্তুর ধর্ম, প্রাণের ধর্ম, জীবের ধর্ম, মানুষের ধর্ম ইত্যাদি। ‘বিজ্ঞান’ নয় ‘প্রযুক্তি’। ধর্ম নয় রিলিজিয়ন। রিলিজিয়ন নয় ধর্ম বা দ্বীন বা উপাসনা।
২/ ‘বিজ্ঞান’-এর একটা কোনো উৎস বা কেন্দ্র নাই, নাই একটা মাত্র ধারণা বা একটা সরল রৈখিক ইতিহাস। শূন্য , বীজগণিত, আপেক্ষিকতার সূত্র কিংবা ইউনানী-আয়ুর্বেদী- কবিরাজী-হেকিমি চিকিৎসা/ ঔষধ কিংবা চাকা, নৌযান, জ্যোতির্বিজ্ঞান কিংবা কৃষি-খাদ্য-আবাস-পশুপালন কিংবা সুর-ছন্দ-রচনা-ভাষা-সমাজ-ইতিহাস-অর্থনীতির জ্ঞানের ইতিহাস দেখলেও সেসব আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু এসবই জ্ঞানের/বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের কিছু প্রকার উদাহরণ মাত্র।
৩/ দুনিয়ার সব অঞ্চলের সব রকম মানুষের বহুরকম জীবন-অভিজ্ঞতা-অনুশীলন-অনুসন্ধিৎসা-জ্ঞান-বিজ্ঞান-ধর্ম-সংস্কৃতির বিচিত্র-বহুরৈখিক ইতিহাস রচনা করছে। সেসব জ্ঞান-বিজ্ঞানের গ্রহণ-পরিগ্রহণ-দখল-আত্মীকরণ-স্থানান্তর-ভাষান্তর-রূপান্তর-পারস্পারিক প্রভাব-পরিগঠনের ইতিহাস আছে। পশ্চিম/ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ এই ইতিহাসের বড় এক পরিচ্ছেদ।
৪/ সামাজিক-সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা যেমনঃ উপাসনা/ধর্ম/দ্বীন/জীবনবিধান/জীবনব্যবস্থা্র বিকাশ/পরিবর্তন/বিবর্তনের বাঙময় ইতিহাসের মধ্যে যেমন ‘বিজ্ঞান’ অংশ, তেমনি এসব জ্ঞান/সংস্কৃতির বিকাশ-বিবর্তনের ক্ষেত্রে ‘বিজ্ঞান’ বা পদ্ধতি-পর্যালোচনামূলক জ্ঞান অনুশীলনের ভূমিকা আছে। ফলে, এটা ‘দুই’ হয়ে বিচ্ছিন্ন ইতিহাস হওয়ার আবশ্যকতা নাই বা ছিলো না প্রাক-পশ্চিমা ঔপনিবেশিক ‘আলোকায়ন’ প্রভাবের আগে। ‘বিজ্ঞান’ প্রতিষ্ঠান আকারে, ‘ধর্ম’ প্রতিষ্ঠান আকারে বিভিন্ন সমাজে হাজির হবার মধ্যে দিয়া এই ‘দুই’, দুই হয়ে উঠছে। ‘বিজ্ঞানবাদ’ এবং ‘ধর্ম’বাদ এই বিভাজন/ পৃথকীকরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার নাম। যা পরে একটা জোড়-বিপরীত(binary) হিসেবে চিন্তা এবং জ্ঞান জগতে রূপ ও প্রতিষ্ঠা পায়।
৫/ ‘ধর্ম’ বনাম ‘বিজ্ঞান’- একটা সাম্প্রতিক, ‘আলোকায়ন’ প্রভাবিত জোড়-বিপরীত(binary)। ঔপনিবেশিক আধুনিকতার ‘আলোকায়ন’ প্রভাবের আগে এরকম খাড়া খাড়ি জোড়-বিপরীত চর্চার সামাজিক ইতিহাস দেখা যায়না। আবার, ‘পশ্চিমা আধুনিকতা’ নিজেও দ্বন্দ্ব-বিরোধ/আভ্যন্তরীন টানা-পোড়েনবিহীন একহারা/মনোলিথিক ঘটনা না।
৬/ যুক্তি বনাম আবেগ দেখা, বস্তু বনাম ভাব দেখা, আলো বনাম অন্ধকার দেখা, পশ্চিম বনাম পূর্ব দেখা, সভ্যতা/বিজ্ঞানের ‘কেন্দ্র’, উৎস ইত্যাদির দাবী, শ্রেষ্ঠত্বের দাবী, ‘ধর্ম’র যৌক্তিক সামঞ্জস্যের (coherence)চাহিদা- সবি নানা সামাজিক- ঐতিহাসিক- প্রতিবেশগত অভিজ্ঞতা ও ভাব-বোঝাপড়ার প্রকাশ, কোনোটাই ‘মানবীয়’ জ্ঞান-অভিজ্ঞতা’র বাইরের বোঝাপড়া, ভাষ্য বা দৃষ্টিভঙ্গী না। একটা নোক্তাঃ ‘আস্তিক’-‘নাস্তিক’ জোড়-বিপরীত ধরে যে বিতর্ক চলে আজকাল, দুনিয়ায় ইতিহাসে ‘আধুনিক’ ‘ধর্মপ্রতিষ্ঠান’ হাজির হবার আগে, ‘ভারতবর্ষে’ এই দুইটা শব্দ ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করতো। তখন সেটা ছিলো প্রধানত জ্ঞান বা সত্য প্রমানের পদ্ধতির তর্ক। এটা রব বা উপাস্যর অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের তর্ক হয়া ওঠে ‘আধুনিক’ কালে।
৭/ জ্ঞান-বিজ্ঞান নিজে কোনো একহারা, সমসত্ত্ব, নিপাট, অবিসম্বাদিত মত-অভিজ্ঞতা-দৃষ্টিভঙ্গির ইতিহাস না। না- ধর্ম/বিজ্ঞানের একক কোনো কেন্দ্র/ব্যাখ্যা/ভাষ্য/অভিজ্ঞতা আছে, না ‘মানব সমাজ’ এর। জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধকদের/সমাজগুলার বহু মত ও ব্যাখ্যা আছে, আছে সামাজিক-সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা ও বোঝাপড়ার পার্থক্য, আছে এক সমাজ-সংস্কৃতিতে বিকশিত জ্ঞান-বিজ্ঞান, আরেক সমাজ-সংস্কৃতিতে গ্রহণ-বর্জন-রূপান্তর-প্রভাবক ভূমিকা। প্রায় কোনো ধর্ম-মতের প্রভাবাধীন সমাজই এমন লেনদেন- রূপান্তরের বাইরে নয়।
৮/ ধর্মকে ‘আদিবিজ্ঞান’ দাবী করা, ধর্মকে ‘বিজ্ঞান’সম্মত বা সর্বোচ্চ ‘বিজ্ঞান’ দাবী করা, ‘বিজ্ঞান’কে ‘ধর্ম’সম্মত হইতে বলা, ‘ধর্ম’সম্মত করার চেষ্টা করা… সবই সাম্প্রতিক, সংকোচনবাদী, ‘আধুনিক’ ‘বিজ্ঞানবাদী’ দাবী/চাহিদা। ‘ধর্ম’সমুহ এবং ‘বৈজ্ঞানিক জ্ঞান’ বিকাশের ইতিহাস এমন দাবী, চাহিদা এবং সমান্তরাল বিকাশের প্রমান দেয় না। অনেক ক্ষেত্রেই ‘ট্র্যাডিশনাল’ জ্ঞান/বিজ্ঞান/গল্প/ইতিহাস আর ‘ধর্মীয়’ জ্ঞানপ্রবাহের পার্থক্য রেখা টানা যায় না। ‘ধর্ম’ এবং ‘জ্ঞান-বিজ্ঞান’ এর একহারা/নিপাট/সমান্তরাল বিকাশের ইতিহাস নাই। দুইয়ের বহুমাত্রিক সম্পর্ক ‘দুই’ হওয়ার ইতিহাস থেকে শুরু, এখনো বিকাশমান।
৯/ নানা শাসনব্যবস্থায় অনেক দেশ-কালে অনেক সাধক ‘জ্ঞান-বিজ্ঞান’ এ বিপুল অবদান রেখেছেন, এটা যেমন ঐতিহাসিক সত্য, তেমনি কায়েমী মতের/স্বার্থের বাইরে মত প্রকাশ করায় জুলুমের শিকার হয়েছেন অনেক জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধক, এমন ঘটনা আছে- কিন্তু সেসবের কারণ ‘বিজ্ঞান বনাম ধর্ম’এর আজকের বিতর্কের অর্থে নয়, সেসব দেশ কালের রাজনৈতিক কারণ-প্রেক্ষিতে। স্বর্ণযুগ নস্টালজিয়া নিজেই ‘আধুনিক’তা প্রভাবিত অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা অনেক ক্ষেত্রেই পুনর্জাগরণবাদী (revivalist) এবং পরিচয়বাদী জুলুমশাহীর অঙ্কুরোদগম ঘটাতে ভূমিকা রাখে।
১০/ মজলুমের পাঠরীতি দিয়ে ইতিহাস পড়লে আমরা দেখতে পাবোঃ বিজ্ঞান-ধর্ম জোড়-বিপরীত প্রাচ্যবাদী/অরিয়েন্টালিস্ট বাইনারী। পশ্চিমা ঔপনিবেশিক বর্ণবাদী আধুনিক পুঁজিবাদ পুরুষতন্ত্রের জটিল সম্পর্কের মধ্যে বিকশিত প্রভাবশালী ‘বস্তু-ভাব’, ‘স্পিরিচ্যুয়াল’-‘ম্যাটেরিয়াল’, ‘আধ্যাত্মিকতা-বস্তুবাদিতা’ , ‘আবেগ- যুক্তি’, ‘প্রগতি-পশ্চাদপদতা’, ‘সভ্যতা- বর্বরতা’, ‘উন্নতি-অনুন্নতি’ জোড় বিপরীতের সাথে যুক্ত থাকা ‘ধর্ম- বিজ্ঞান’ বাইনারী দুনিয়া জোড়া ঔপনিবেশিক আর সাম্রাজ্যবাদী জুলুমশাহীর সাংস্কৃতিক-জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি, ওয়ার অন টেরর প্রকল্পেরও একটা ভিত্তি ও সেবক বাইনারি। আর এসব বাইনারি দেশে দেশে বর্ণবাদী, পরিচয়বাদী, পুরুষতান্ত্রিক-পুঁজিবাদী জুলু্মশাহীর সেবক বাইনারী।
১১/ তাই আমাদের ভাবা দরকারঃ কীভাবে, কতভাবে, কত প্রক্রিয়ায় ‘ধর্ম’ এবং ‘বিজ্ঞান’ নামের ‘আধুনিক’ প্রতিষ্ঠানগুলি সমাজে হাজির হইলো বা ‘ধর্ম’ এবং ‘বিজ্ঞান’ ‘আধুনিক’ সকল বুঝ-ভাষা-ভঙ্গি-ব্যাখ্যা-অনুশীলন-রীতি-নীতি বদ্ধ বা প্রভাবিত হয়ে উঠলো কখন, কীভাবে, কি সব প্রক্রিয়ায়? পশ্চিমা-ঔপনিবেশিক-বর্ণবাদী আধুনিকতা- শিল্পবিপ্লব- পুঁজিবাদ-গ্লোবালাইজেশন, ধর্ম এবং বিজ্ঞানের এই প্রাতিষ্ঠানিকতা প্রাপ্তিতে কীভাবে কতখানি ভূমিকা রাখলো। ‘ধর্ম’ ও ‘বিজ্ঞান’ আধুনিক প্রতিষ্ঠানের সুবিধা-সমস্যা-স্বরুপ বোঝার উপায় কি? জোড়-বিপরীত(binary) মডেলের চিন্তা-পদ্ধতি দিয়ে কি সমাজ-ইতিহাসের জটিল, বহুমাত্রিক, বহুরৈখিক গঠন, অভিজ্ঞতা, পরিচলন-পরিবর্তন আদৌ সম্যক বোঝা সম্ভব? না কি জোড়-বিপরীত ভিত্তিক চিন্তা-পদ্ধতির বাইরে যাওয়া জরুরি? বর্ণবাদ, পুরুষতন্ত্র, পরিচয়বাদ, শ্রেণী জুলুম, পরিবেশ এবং জলবায়ু সংকট- এসব অভিজ্ঞতা কি ‘ধর্ম’ ও ‘বিজ্ঞান’ প্রতিষ্ঠানের স্বরুপ বুঝতে সাহায্য করে?
১২/ পশ্চিমা ঔপনিবেশিক বর্ণবাদী পুঁজিবাদ, পুরুষতন্ত্র, জাতি/পরিচয়বাদ, রাষ্ট্রবাদ সব কিছু মিলে যে জুলুমশাহী, জোড়-বিপরীত চিন্তা মডেল এই জুলুমশাহী’র প্রধানতম নিয়ামক। তাহলে এই জুলুমশাহীর ক্রিটিক/পর্যালোচনা করতে সক্ষম ভাব-জ্ঞান-অনুশীলন-সাধনা কেমন সাধনা? সে সাধনার প্রক্রিয়ায় সব সমাজ যদি অংশ নেয়, তাহলে ‘বিজ্ঞান’ এবং ‘ধর্ম’ গুলার আজকের কায়েমী বুঝ-অনুশীলন কি আর বহাল থাকবে? নতুন এক অভিজ্ঞতার পর্বে দুনিয়া প্রবেশ করবে না?
তাহলে আলাপটা বিজ্ঞান বনাম ধর্ম নয়। প্রশ্ন করতে হবে, বিজ্ঞান ও ধর্মের ঔপনিবেশিক- সাম্রাজ্যবাদী-বর্ণবাদী-পুরুষতান্ত্রিক জ্ঞান-প্রতিষ্ঠানকে, এর ধ্যানধারণা- অনুশীলনকে। সাধনা করতে হবে বিজ্ঞান এবং ধর্মের ধ্যান- ধারণা-অনুশীলনের বিউপনিবেশায়নের। বিউপনিবেশায়ন কোনো স্বর্ণালী অতীত, স্বর্ণযুগ, গর্বের অতীত, বিশুদ্ধ অতীত ইত্যাদিতে ফেরা বা ফিরিয়ে আনার সাধনা না, ওসবে ফেরা যায় না বা ফেরানো যায় না। এমন ফেরা বা ফেরানোর কল্পনা নিজেই একটা সমস্যাঃ আধুনিকতার অভিজ্ঞতার সংগে সম্পর্কিত। বিউপনিবেশায়ন এই কল্পনার ঐতিহাসিক-সামাজিক উৎসকে বোঝা, চলমান জুলুমশাহীকে বোঝা, জুলুমশাহীর জ্ঞানপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়াকে বোঝা এবং জুলুমশাহীর জ্ঞান- বিজ্ঞান-ধর্ম-সমাজ-জীবনব্যবস্থা থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করার বহুমাত্রিক-বহুরৈখিক সাধনার মধ্যে দিয়ে জ্ঞান-সমাজ-ইতিহাসের নতুন পর্ব হাজির করতে থাকা, বর্তমানে।
আমাদের সমাজে অতি সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত ‘আরব’ , ‘জাহেলিয়া ‘ আর ‘ইসলাম’ সম্পর্কে– ‘ঐতিহাসিক জ্ঞান’এর প্রধান রসদগুলারমধ্যে আছে কোরান , বহুরকম হাদিস, কিছু হামদ– নাত, কিছু সিরাতুন্নবী; আছে ‘বিষাদ সিন্ধুর’ কারবালা– ফোরাত বর্ণনা, প্রাচীন পর্যটক আর মুসাফির/সুফি/ফকির পর্যটকদের বর্ণনার বাংলা রূপান্তর, আর ইরাক, পারস্য অঞ্চলের মনিষী–সাধকদের রচনা/কাহিনীর নানা রুপ ; আছে মাদ্রাসা ধরণের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আরবী চর্চা থেকে সমাজে যা যা কথ্য এবং লেখ্য রুপে এবং স্থানীয়– বৈশ্বিক প্রচার মাধ্যমে বাংলা বা অন্যান্য স্থানীয় ভাষায় যা যা আসে ।
এর বাইরে , কথিত ‘সেক্যুলার’ শিক্ষা/জ্ঞান ব্যবস্থায় / বাংলা ভাষায় ফিলিপ কে হিটি( Philip Khuri Hitti)র History of the Arabs এর প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ ‘র করা বাংলা অনুবাদ প্রথমে ‘ আরব জাতির ইতিকথা’ নামে এবং পরে ‘ আরব জাতির ইতিহাস নামে, ১৯৫৯ সাল থেকে বাংলাদেশে, বাংলা ভাষায় ‘আরব জাতি’র ইতিহাস বোঝার প্রধানতম একটা বইয়ে পরিনত হয়। হিটি এই বাংলা সংস্করণ প্রকাশের ভূমিকা লিখেন। বাংলা বইয়ের ‘অগ্র লেখা ‘ লিখে দেন ঢাকার মাদ্রাসা–ই–আলিয়ার মওলানা মুস্তাফিজুর রহমান, ১৯৫৮ সালে। সেকালের ইসলামিক একাডেমি প্রকাশ করে এই সংস্করণ।
এর বাইরে ৯/১১ পর্যন্ত বাংলায় ও বাংলাদেশে আরব, জাহেলিয়া এবং ইসলাম সম্পর্কে ‘জনপ্রিয়’ তেমন কোনো ইতিহাস বই নাই। । ৯/১১ এর পর সারা দুনিয়াতেই নতুন করে ইসলাম, আরব, মধ্যপ্রাচ্য, আব্রাহামিক ধর্মগুলার ইতিহাস এবং ধর্ম অধ্যয়ন শাস্ত্রের বিপুল পাঠ, অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা শুরু হয়।
বাংলাদেশে ও বাংলাভাষাতে ইসলাম প্রসঙ্গে ইংরেজী ভাষা, পশ্চিম ও জনপ্রিয় পাঠ জগতের লেখক ও ইতিহাসকারদের জনপ্রিয় ধাচের রচনা অনুদিত হইতে শুরু করে। বাংলাভাষী/ বাংলাদেশের লেখকদের নিজস্ব রচনা লক্ষ্যনীয়ভাবে হাতে গোনা । তার দুই একটা বাদে বাকীগুলি অনেকেরই জরুরতের বিবেচনায় পাঠ তালিকা বহির্ভূত থাকবে।
৯/১১ এর আগেও, ৮০/৯০/০০ দশকে বিভিন্ন মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন অঞ্চলের সরকারী–বেসরকারী প্রকল্প সহযোগিতায় অনেক ‘ইসলামি লিটারেচার’ বাংলায় অনুবাদ হয়, যার ধারা এখনো প্রবহমান। কিন্তু সেসব অনুবাদের তালিকায় ‘পদ্ধতিগত ইতিহাস চর্চা’র জায়গা থেকে রচিত আরব/জাহেলিয়া/ইসলামের ইতিহাসের বই/আলাপ তেমন লক্ষ্য করা যায় না। কেন নাই– সেটার সামাজিক–ঐতিহাসিক পর্যালোচনা এই আলোচনার লক্ষ্য না। ‘পদ্ধতিগত ইতিহাসচর্চা’ই এখানে প্রশ্ন।
On the Politics of the film 'Moner Manush'. The film is about Lalon Fakir and the baul-fakir tradition of Bengal. But To what extent this film represents these this tradition and how? What is the cultural politics of this film ? How do we understand this film in a context of commodification and appropriation of the traditions and values of these radical praxises?
{ “কী করো শ্বশুর লেখাজোখা, মেঘেই দেখ জলের রেখা’’- খনা
“Because nothing is less neutral, in the world of society, than the authoritative utterance of Being; the findings of science inevitably exert a political effect, which may not be that which the scholar intended.” – Pierre Bourdieu
“One could not be a calm, cool, and detached scientist while Negroes were lynched, murdered, and starved.” – W E B Du Bois }
১/ ‘ধর্ম’, জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তির চালু ধারণাগুলি নিত্য বা চিরন্তন নয়। অনিত্য, ‘আধুনিক’ ও পরিবর্তনশীল। যেমন, চিন্তা করেনঃ বাংলা-সংস্কৃত-সনাতন ট্র্যাডিশনে ‘বিজ্ঞান’ এর এক সময়ে অর্থ ছিলো বিশেষ মানসিক অবস্থাঃ ‘চেতন’, মনোভাব’, ‘সংস্কার’ ইত্যাদি। ধর্ম মানে ছিলো বস্তুর ধর্ম, প্রাণের ধর্ম, জীবের ধর্ম, মানুষের ধর্ম ইত্যাদি। ‘বিজ্ঞান’ নয় ‘প্রযুক্তি’। ধর্ম নয় রিলিজিয়ন। রিলিজিয়ন নয় ধর্ম বা দ্বীন বা উপাসনা।
২/ ‘বিজ্ঞান’-এর একটা কোনো উৎস বা কেন্দ্র নাই, নাই একটা মাত্র ধারণা বা একটা সরল রৈখিক ইতিহাস। শূন্য , বীজগণিত, আপেক্ষিকতার সূত্র কিংবা ইউনানী-আয়ুর্বেদী- কবিরাজী-হেকিমি চিকিৎসা/ ঔষধ কিংবা চাকা, নৌযান, জ্যোতির্বিজ্ঞান কিংবা কৃষি-খাদ্য-আবাস-পশুপালন কিংবা সুর-ছন্দ-রচনা-ভাষা-সমাজ-ইতিহাস-অর্থনীতির জ্ঞানের ইতিহাস দেখলেও সেসব আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু এসবই জ্ঞানের/বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের কিছু প্রকার উদাহরণ মাত্র।
৩/ দুনিয়ার সব অঞ্চলের সব রকম মানুষের বহুরকম জীবন-অভিজ্ঞতা-অনুশীলন-অনুসন্ধিৎসা-জ্ঞান-বিজ্ঞান-ধর্ম-সংস্কৃতির বিচিত্র-বহুরৈখিক ইতিহাস রচনা করছে। সেসব জ্ঞান-বিজ্ঞানের গ্রহণ-পরিগ্রহণ-দখল-আত্মীকরণ-স্থানান্তর-ভাষান্তর-রূপান্তর-পারস্পারিক প্রভাব-পরিগঠনের ইতিহাস আছে। পশ্চিম/ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ এই ইতিহাসের বড় এক পরিচ্ছেদ।
৪/ সামাজিক-সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা যেমনঃ উপাসনা/ধর্ম/দ্বীন/জীবনবিধান/জীবনব্যবস্থা্র বিকাশ/পরিবর্তন/বিবর্তনের বাঙময় ইতিহাসের মধ্যে যেমন ‘বিজ্ঞান’ অংশ, তেমনি এসব জ্ঞান/সংস্কৃতির বিকাশ-বিবর্তনের ক্ষেত্রে ‘বিজ্ঞান’ বা পদ্ধতি-পর্যালোচনামূলক জ্ঞান অনুশীলনের ভূমিকা আছে। ফলে, এটা ‘দুই’ হয়ে বিচ্ছিন্ন ইতিহাস হওয়ার আবশ্যকতা নাই বা ছিলো না প্রাক-পশ্চিমা ঔপনিবেশিক ‘আলোকায়ন’ প্রভাবের আগে। ‘বিজ্ঞান’ প্রতিষ্ঠান আকারে, ‘ধর্ম’ প্রতিষ্ঠান আকারে বিভিন্ন সমাজে হাজির হবার মধ্যে দিয়া এই ‘দুই’, দুই হয়ে উঠছে। ‘বিজ্ঞানবাদ’ এবং ‘ধর্ম’বাদ এই বিভাজন/ পৃথকীকরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার নাম। যা পরে একটা জোড়-বিপরীত(binary) হিসেবে চিন্তা এবং জ্ঞান জগতে রূপ ও প্রতিষ্ঠা পায়।
৫/ ‘ধর্ম’ বনাম ‘বিজ্ঞান’- একটা সাম্প্রতিক, ‘আলোকায়ন’ প্রভাবিত জোড়-বিপরীত(binary)। ঔপনিবেশিক আধুনিকতার ‘আলোকায়ন’ প্রভাবের আগে এরকম খাড়া খাড়ি জোড়-বিপরীত চর্চার সামাজিক ইতিহাস দেখা যায়না। আবার, ‘পশ্চিমা আধুনিকতা’ নিজেও দ্বন্দ্ব-বিরোধ/আভ্যন্তরীন টানা-পোড়েনবিহীন একহারা/মনোলিথিক ঘটনা না।
৬/ যুক্তি বনাম আবেগ দেখা, বস্তু বনাম ভাব দেখা, আলো বনাম অন্ধকার দেখা, পশ্চিম বনাম পূর্ব দেখা, সভ্যতা/বিজ্ঞানের ‘কেন্দ্র’, উৎস ইত্যাদির দাবী, শ্রেষ্ঠত্বের দাবী, ‘ধর্ম’র যৌক্তিক সামঞ্জস্যের (coherence)চাহিদা- সবি নানা সামাজিক- ঐতিহাসিক- প্রতিবেশগত অভিজ্ঞতা ও ভাব-বোঝাপড়ার প্রকাশ, কোনোটাই ‘মানবীয়’ জ্ঞান-অভিজ্ঞতা’র বাইরের বোঝাপড়া, ভাষ্য বা দৃষ্টিভঙ্গী না। একটা নোক্তাঃ ‘আস্তিক’-‘নাস্তিক’ জোড়-বিপরীত ধরে যে বিতর্ক চলে আজকাল, দুনিয়ায় ইতিহাসে ‘আধুনিক’ ‘ধর্মপ্রতিষ্ঠান’ হাজির হবার আগে, ‘ভারতবর্ষে’ এই দুইটা শব্দ ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করতো। তখন সেটা ছিলো প্রধানত জ্ঞান বা সত্য প্রমানের পদ্ধতির তর্ক। এটা রব বা উপাস্যর অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের তর্ক হয়া ওঠে ‘আধুনিক’ কালে।
৭/ জ্ঞান-বিজ্ঞান নিজে কোনো একহারা, সমসত্ত্ব, নিপাট, অবিসম্বাদিত মত-অভিজ্ঞতা-দৃষ্টিভঙ্গির ইতিহাস না। না- ধর্ম/বিজ্ঞানের একক কোনো কেন্দ্র/ব্যাখ্যা/ভাষ্য/অভিজ্ঞতা আছে, না ‘মানব সমাজ’ এর। জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধকদের/সমাজগুলার বহু মত ও ব্যাখ্যা আছে, আছে সামাজিক-সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা ও বোঝাপড়ার পার্থক্য, আছে এক সমাজ-সংস্কৃতিতে বিকশিত জ্ঞান-বিজ্ঞান, আরেক সমাজ-সংস্কৃতিতে গ্রহণ-বর্জন-রূপান্তর-প্রভাবক ভূমিকা। প্রায় কোনো ধর্ম-মতের প্রভাবাধীন সমাজই এমন লেনদেন- রূপান্তরের বাইরে নয়।
৮/ ধর্মকে ‘আদিবিজ্ঞান’ দাবী করা, ধর্মকে ‘বিজ্ঞান’সম্মত বা সর্বোচ্চ ‘বিজ্ঞান’ দাবী করা, ‘বিজ্ঞান’কে ‘ধর্ম’সম্মত হইতে বলা, ‘ধর্ম’সম্মত করার চেষ্টা করা… সবই সাম্প্রতিক, সংকোচনবাদী, ‘আধুনিক’ ‘বিজ্ঞানবাদী’ দাবী/চাহিদা। ‘ধর্ম’সমুহ এবং ‘বৈজ্ঞানিক জ্ঞান’ বিকাশের ইতিহাস এমন দাবী, চাহিদা এবং সমান্তরাল বিকাশের প্রমান দেয় না। অনেক ক্ষেত্রেই ‘ট্র্যাডিশনাল’ জ্ঞান/বিজ্ঞান/গল্প/ইতিহাস আর ‘ধর্মীয়’ জ্ঞানপ্রবাহের পার্থক্য রেখা টানা যায় না। ‘ধর্ম’ এবং ‘জ্ঞান-বিজ্ঞান’ এর একহারা/নিপাট/সমান্তরাল বিকাশের ইতিহাস নাই। দুইয়ের বহুমাত্রিক সম্পর্ক ‘দুই’ হওয়ার ইতিহাস থেকে শুরু, এখনো বিকাশমান।
৯/ নানা শাসনব্যবস্থায় অনেক দেশ-কালে অনেক সাধক ‘জ্ঞান-বিজ্ঞান’ এ বিপুল অবদান রেখেছেন, এটা যেমন ঐতিহাসিক সত্য, তেমনি কায়েমী মতের/স্বার্থের বাইরে মত প্রকাশ করায় জুলুমের শিকার হয়েছেন অনেক জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধক, এমন ঘটনা আছে- কিন্তু সেসবের কারণ ‘বিজ্ঞান বনাম ধর্ম’এর আজকের বিতর্কের অর্থে নয়, সেসব দেশ কালের রাজনৈতিক কারণ-প্রেক্ষিতে। স্বর্ণযুগ নস্টালজিয়া নিজেই ‘আধুনিক’তা প্রভাবিত অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা অনেক ক্ষেত্রেই পুনর্জাগরণবাদী (revivalist) এবং পরিচয়বাদী জুলুমশাহীর অঙ্কুরোদগম ঘটাতে ভূমিকা রাখে।
১০/ মজলুমের পাঠরীতি দিয়ে ইতিহাস পড়লে আমরা দেখতে পাবোঃ বিজ্ঞান-ধর্ম জোড়-বিপরীত প্রাচ্যবাদী/অরিয়েন্টালিস্ট বাইনারী। পশ্চিমা ঔপনিবেশিক বর্ণবাদী আধুনিক পুঁজিবাদ পুরুষতন্ত্রের জটিল সম্পর্কের মধ্যে বিকশিত প্রভাবশালী ‘বস্তু-ভাব’, ‘স্পিরিচ্যুয়াল’-‘ম্যাটেরিয়াল’, ‘আধ্যাত্মিকতা-বস্তুবাদিতা’ , ‘আবেগ- যুক্তি’, ‘প্রগতি-পশ্চাদপদতা’, ‘সভ্যতা- বর্বরতা’, ‘উন্নতি-অনুন্নতি’ জোড় বিপরীতের সাথে যুক্ত থাকা ‘ধর্ম- বিজ্ঞান’ বাইনারী দুনিয়া জোড়া ঔপনিবেশিক আর সাম্রাজ্যবাদী জুলুমশাহীর সাংস্কৃতিক-জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি, ওয়ার অন টেরর প্রকল্পেরও একটা ভিত্তি ও সেবক বাইনারি। আর এসব বাইনারি দেশে দেশে বর্ণবাদী, পরিচয়বাদী, পুরুষতান্ত্রিক-পুঁজিবাদী জুলু্মশাহীর সেবক বাইনারী।
১১/ তাই আমাদের ভাবা দরকারঃ কীভাবে, কতভাবে, কত প্রক্রিয়ায় ‘ধর্ম’ এবং ‘বিজ্ঞান’ নামের ‘আধুনিক’ প্রতিষ্ঠানগুলি সমাজে হাজির হইলো বা ‘ধর্ম’ এবং ‘বিজ্ঞান’ ‘আধুনিক’ সকল বুঝ-ভাষা-ভঙ্গি-ব্যাখ্যা-অনুশীলন-রীতি-নীতি বদ্ধ বা প্রভাবিত হয়ে উঠলো কখন, কীভাবে, কি সব প্রক্রিয়ায়? পশ্চিমা-ঔপনিবেশিক-বর্ণবাদী আধুনিকতা- শিল্পবিপ্লব- পুঁজিবাদ-গ্লোবালাইজেশন, ধর্ম এবং বিজ্ঞানের এই প্রাতিষ্ঠানিকতা প্রাপ্তিতে কীভাবে কতখানি ভূমিকা রাখলো। ‘ধর্ম’ ও ‘বিজ্ঞান’ আধুনিক প্রতিষ্ঠানের সুবিধা-সমস্যা-স্বরুপ বোঝার উপায় কি? জোড়-বিপরীত(binary) মডেলের চিন্তা-পদ্ধতি দিয়ে কি সমাজ-ইতিহাসের জটিল, বহুমাত্রিক, বহুরৈখিক গঠন, অভিজ্ঞতা, পরিচলন-পরিবর্তন আদৌ সম্যক বোঝা সম্ভব? না কি জোড়-বিপরীত ভিত্তিক চিন্তা-পদ্ধতির বাইরে যাওয়া জরুরি? বর্ণবাদ, পুরুষতন্ত্র, পরিচয়বাদ, শ্রেণী জুলুম, পরিবেশ এবং জলবায়ু সংকট- এসব অভিজ্ঞতা কি ‘ধর্ম’ ও ‘বিজ্ঞান’ প্রতিষ্ঠানের স্বরুপ বুঝতে সাহায্য করে?
১২/ পশ্চিমা ঔপনিবেশিক বর্ণবাদী পুঁজিবাদ, পুরুষতন্ত্র, জাতি/পরিচয়বাদ, রাষ্ট্রবাদ সব কিছু মিলে যে জুলুমশাহী, জোড়-বিপরীত চিন্তা মডেল এই জুলুমশাহী’র প্রধানতম নিয়ামক। তাহলে এই জুলুমশাহীর ক্রিটিক/পর্যালোচনা করতে সক্ষম ভাব-জ্ঞান-অনুশীলন-সাধনা কেমন সাধনা? সে সাধনার প্রক্রিয়ায় সব সমাজ যদি অংশ নেয়, তাহলে ‘বিজ্ঞান’ এবং ‘ধর্ম’ গুলার আজকের কায়েমী বুঝ-অনুশীলন কি আর বহাল থাকবে? নতুন এক অভিজ্ঞতার পর্বে দুনিয়া প্রবেশ করবে না?
তাহলে আলাপটা বিজ্ঞান বনাম ধর্ম নয়। প্রশ্ন করতে হবে, বিজ্ঞান ও ধর্মের ঔপনিবেশিক- সাম্রাজ্যবাদী-বর্ণবাদী-পুরুষতান্ত্রিক জ্ঞান-প্রতিষ্ঠানকে, এর ধ্যানধারণা- অনুশীলনকে। সাধনা করতে হবে বিজ্ঞান এবং ধর্মের ধ্যান- ধারণা-অনুশীলনের বিউপনিবেশায়নের। বিউপনিবেশায়ন কোনো স্বর্ণালী অতীত, স্বর্ণযুগ, গর্বের অতীত, বিশুদ্ধ অতীত ইত্যাদিতে ফেরা বা ফিরিয়ে আনার সাধনা না, ওসবে ফেরা যায় না বা ফেরানো যায় না। এমন ফেরা বা ফেরানোর কল্পনা নিজেই একটা সমস্যাঃ আধুনিকতার অভিজ্ঞতার সংগে সম্পর্কিত। বিউপনিবেশায়ন এই কল্পনার ঐতিহাসিক-সামাজিক উৎসকে বোঝা, চলমান জুলুমশাহীকে বোঝা, জুলুমশাহীর জ্ঞানপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়াকে বোঝা এবং জুলুমশাহীর জ্ঞান- বিজ্ঞান-ধর্ম-সমাজ-জীবনব্যবস্থা থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করার বহুমাত্রিক-বহুরৈখিক সাধনার মধ্যে দিয়ে জ্ঞান-সমাজ-ইতিহাসের নতুন পর্ব হাজির করতে থাকা, বর্তমানে।
আমাদের সমাজে অতি সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত ‘আরব’ , ‘জাহেলিয়া ‘ আর ‘ইসলাম’ সম্পর্কে– ‘ঐতিহাসিক জ্ঞান’এর প্রধান রসদগুলারমধ্যে আছে কোরান , বহুরকম হাদিস, কিছু হামদ– নাত, কিছু সিরাতুন্নবী; আছে ‘বিষাদ সিন্ধুর’ কারবালা– ফোরাত বর্ণনা, প্রাচীন পর্যটক আর মুসাফির/সুফি/ফকির পর্যটকদের বর্ণনার বাংলা রূপান্তর, আর ইরাক, পারস্য অঞ্চলের মনিষী–সাধকদের রচনা/কাহিনীর নানা রুপ ; আছে মাদ্রাসা ধরণের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আরবী চর্চা থেকে সমাজে যা যা কথ্য এবং লেখ্য রুপে এবং স্থানীয়– বৈশ্বিক প্রচার মাধ্যমে বাংলা বা অন্যান্য স্থানীয় ভাষায় যা যা আসে ।
এর বাইরে , কথিত ‘সেক্যুলার’ শিক্ষা/জ্ঞান ব্যবস্থায় / বাংলা ভাষায় ফিলিপ কে হিটি( Philip Khuri Hitti)র History of the Arabs এর প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ ‘র করা বাংলা অনুবাদ প্রথমে ‘ আরব জাতির ইতিকথা’ নামে এবং পরে ‘ আরব জাতির ইতিহাস নামে, ১৯৫৯ সাল থেকে বাংলাদেশে, বাংলা ভাষায় ‘আরব জাতি’র ইতিহাস বোঝার প্রধানতম একটা বইয়ে পরিনত হয়। হিটি এই বাংলা সংস্করণ প্রকাশের ভূমিকা লিখেন। বাংলা বইয়ের ‘অগ্র লেখা ‘ লিখে দেন ঢাকার মাদ্রাসা–ই–আলিয়ার মওলানা মুস্তাফিজুর রহমান, ১৯৫৮ সালে। সেকালের ইসলামিক একাডেমি প্রকাশ করে এই সংস্করণ।
এর বাইরে ৯/১১ পর্যন্ত বাংলায় ও বাংলাদেশে আরব, জাহেলিয়া এবং ইসলাম সম্পর্কে ‘জনপ্রিয়’ তেমন কোনো ইতিহাস বই নাই। । ৯/১১ এর পর সারা দুনিয়াতেই নতুন করে ইসলাম, আরব, মধ্যপ্রাচ্য, আব্রাহামিক ধর্মগুলার ইতিহাস এবং ধর্ম অধ্যয়ন শাস্ত্রের বিপুল পাঠ, অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা শুরু হয়।
বাংলাদেশে ও বাংলাভাষাতে ইসলাম প্রসঙ্গে ইংরেজী ভাষা, পশ্চিম ও জনপ্রিয় পাঠ জগতের লেখক ও ইতিহাসকারদের জনপ্রিয় ধাচের রচনা অনুদিত হইতে শুরু করে। বাংলাভাষী/ বাংলাদেশের লেখকদের নিজস্ব রচনা লক্ষ্যনীয়ভাবে হাতে গোনা । তার দুই একটা বাদে বাকীগুলি অনেকেরই জরুরতের বিবেচনায় পাঠ তালিকা বহির্ভূত থাকবে।
৯/১১ এর আগেও, ৮০/৯০/০০ দশকে বিভিন্ন মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন অঞ্চলের সরকারী–বেসরকারী প্রকল্প সহযোগিতায় অনেক ‘ইসলামি লিটারেচার’ বাংলায় অনুবাদ হয়, যার ধারা এখনো প্রবহমান। কিন্তু সেসব অনুবাদের তালিকায় ‘পদ্ধতিগত ইতিহাস চর্চা’র জায়গা থেকে রচিত আরব/জাহেলিয়া/ইসলামের ইতিহাসের বই/আলাপ তেমন লক্ষ্য করা যায় না। কেন নাই– সেটার সামাজিক–ঐতিহাসিক পর্যালোচনা এই আলোচনার লক্ষ্য না। ‘পদ্ধতিগত ইতিহাসচর্চা’ই এখানে প্রশ্ন।