হাসান আজিজুল হক (১৯৩৬-২০২১) বাংলা কথাসাহিত্যের এক কিংবদন্তি স্বরূপ। বাংলা ছোটগল্প রচনায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন তিনি। ষাটের দশকে তিনি কথাসাহিত্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন করেছেন। যাকে বলা হয় নির্মাণধারার সবচেয়ে বেশি পরীক্ষিত কথাসাহিত্যিক। তিনি...
moreহাসান আজিজুল হক (১৯৩৬-২০২১) বাংলা কথাসাহিত্যের এক কিংবদন্তি স্বরূপ। বাংলা ছোটগল্প রচনায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন তিনি। ষাটের দশকে তিনি কথাসাহিত্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন করেছেন। যাকে বলা হয় নির্মাণধারার সবচেয়ে বেশি পরীক্ষিত কথাসাহিত্যিক। তিনি সৃষ্টি করেছেন এক নব ভাষাশৈলী--যা একজন আজিজুল হকের নিজস্ব ভঙ্গিকেই উপস্থাপন করে। হাসান আজিজুল হকের সাহিত্যে ঠাঁই পায় সেই সব মানুষ, যারা বিরূপ নির্মমতার শিকার, যাদের জীবন কাটে আর্থিক অভাব সংকটে। তিনি তাদের কথায় বলতে চান যাদের জীবন নিপীড়ন অভাব-বঞ্চনার শিকার, চোর, ভিক্ষুক, দিন-মজুর, চাষি হয়ে ওঠে তার গল্পের মূল্য উপাদান। হাসান তার গল্প বয়ানে সামান্য কিছুকেই মুহূর্তে অসামান্য বানিয়ে ফেলতে পারেন। নিজের চোখে দেখেছেন মানুষের এই যাতনাময় জীবন। যে কারণে তিনি বারংবার বলতে চেয়েছেন এই সব সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের গল্প। এইসব গল্প মানুষ শুনতেও চাই--এই জন্যই তো গোগ্রাসে মানুষ হাসান আজিজুল হকের গল্পকে গ্রহণও করে নিয়েছেন।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পঞ্চাশের ভয়াবহতম মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সংঘাত, বস্ত্রসংকট, দেশভাগ, উত্তরকালে সৃষ্ট উদ্বাস্তু ও শরণার্থী সমস্যা, পাকিস্তানের স্বৈরশাসন, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সকল পর্যায়, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাস্তবতা, গণতন্ত্রের অপমৃত্যু, সামরিকতন্ত্রের উত্থান ও বিকাশ ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ ঘটনাপ্রবাহ তাঁর কথাসাহিত্যের বিষয়।
বলা যায়, বাঙালির জাতীয় জীবনের অর্ধ-শতাব্দীর অধিককাল ধরে ঘটে যাওয়া সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সকল পরিবর্তনকেই হাসান আজিজুল হক কথাসাহিত্যের বিষয় করেছেন। এছাড়া বাংলা কথাসাহিত্যের নির্মাণকৌশলের প্রতিটি অনুষঙ্গে, যেমন আখ্যান-নির্মাণ, ভাষারীতি, শব্দসৃজন, শব্দচয়ন, বাক্যগঠন, বাক্যবিন্যাস, সংলাপ-নির্মাণ, রূপক-উপমা, চিত্রকল্প ইত্যাদিতে হাসান আজিজুল হক নতুন নতুন মাত্রা যোগ করেন। তিনি গল্পবর্জিত প্রকরণসর্বস্ব কঙ্কালসার আখ্যান নির্মাণের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেন। সময়, সমাজ, দেশ ও মানুষ যে বাস্তবতার মুখোমুখি, এবং যে বাস্তবতার ভেতর দিয়ে তাঁর জীবন অতিবাহিত, সেই বাস্তবতাকে শিল্পায়িত করতে যে ধরনের আখ্যান ও গল্পভাষার প্রয়োজন, হাসান আজিজুল হক ঠিক সেই ধরনের আখ্যান ও গল্পভাষা নিজের মতো করে নির্মাণ করে নিয়েছেন। তিনি গল্প-উপন্যাসের প্রচলিত নির্মাণ-কাঠামোর ধারণা অথবা কোনো ধরনের সংজ্ঞা বা প্রতিষ্ঠিত কোনো সাহিত্যতত্ত্বকে গ্রহণ করেননি। তাঁর প্রতিটি লেখা অভিজ্ঞতার নিজস্ব রূপায়ণ। তাই, তাঁর গল্প-উপন্যাসের নামকরণ থেকে শুরু করে নির্মাণকৌশলের প্রতিটি অনুষঙ্গ স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত।
তাঁর ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ (১৯৬৭) গল্পগ্রন্থের মধ্য দিয়ে তিনি পরিণত শিল্পীরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। দেশ বিভাগের ফলে সৃষ্ট ব্যক্তিচরিত্রের নৈতিক স্খলন সাম্প্রদায়িকতা এবং সংশ্লিষ্ট কারণে সৃষ্ট চরম হতাশা ও দারিদ্র্য, উত্তেজক পরিস্থিতি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে রচিত হয় আত্মজা ও একটি করবী গাছ, পরবাসী, সারাদুপুর, অন্তর্গত নিষাদ, মারী, উটপাখি, সুখের সন্ধানে, আমৃত্যু আজীবন এই আটটি গল্প।
হাসান আজিজুল হকের এসব গল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গল্প ‘আত্মজা একটি করবী গাছ।’ এই গল্প রাজনৈতিক বিভাজন দেশভাগকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। গল্পটি পড়তে গেলেই প্রথমে চোখ আটকে যাবে একটি লাইনে- এ যেন আমাদের কল্পনার কোন লাইন কিংবা চাঁদনি রাতে বাইরের কোনো দৃশ্যকে লেখক পাঠকের সামনে মূর্তিময় করে তুলেছেন। ‘এখন নির্দয় শীতকাল, ঠাণ্ডা নামছে হিম, চাঁদ ফুটে আছে নারিকেল গাছের মাথায়। অল্প বাতাসে একটা বড় কলার পাতা একবার বুক দেখায় একবার পিঠ দেখায়।’ লেখক বাস্তবতার পথ ধরেই বলে যান জীবনের এইসব যাপননির্ভর গল্প। তিনি চোখে দৃশ্যমান বিষয়কেই গল্পে বলার চেষ্টা করেন। লেখককে বাস্তবতার মধ্য দিয়েই চলাচল করতে হয়, তা না হলে তিনি কোনো লেখাকেই জীবনমুখী করে তুলতে পারেন না আর জীবনমুখী করতে হলে তাকে অবশ্যই জীবনের সাথে মিশতে হয়। সেই জীবনঘনিষ্ঠ জীবনই পেয়েছেন কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। তিনি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন ঠিকই কিন্তু তার মন-মননগঠিত হয়েছে রাঢ়বাংলার সমাজ সংস্কৃতি বা ভূপ্রকৃতি দ্বারা। গ্রামীণ জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখা বলেই তিনি জীবনের অভিজ্ঞতায় নিজেকে সাজিয়েছেন একজন পূর্ণ মানুষ হিসেবে। হাসান আজিজুল হক ‘আত্মজা একটি করবী গাছ’ গল্পে বলতে চেয়েছেন দেশভাগের ছিন্নভিন্ন জীবন মানুষকে জীর্ণ-শীর্ণ করে তোলে আর কান্নাজড়িত চোখে ভাসে নিজের ফেলে আসা জীবনের কথা। ইনাম, ফেকু আর সুহাস নাপিতের জীবনেরই এক নির্দয় অভিজ্ঞতাকে লেখক তুলে ধরেছেন এই গল্পে। যা গল্প বর্ণনায় ‘আত্মজা একটি করবী গাছ, দেশভাগের পরবর্তীকালের কোনো এক সময়কেই আশ্রয় করে গল্পের ডালপালা বিকশিত হয়েছে। মানুষের এই যে রাজনৈতিক বিভাজিতর ফ্যারে পড়ে অলিখিত জীবনআখ্যান নিয়ে মানুষকে ঘুরতে হচ্ছে-এখান হতে সেখানে যে অনিশ্চিত জীবনের কথা কারও জানা নেই। এই গল্পের শেষের দিকে করবী বিচি যেন আত্মহননেরই একটি প্রতীক বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে। বৃদ্ধের জীবনযুদ্ধে পরাস্ততায় যেন--করবীর বিচি খেয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন। করবী গাছের চমৎকার বিচি হয়- এই কথা বলে যখন ‘পানিতে ডুবে যেতে যেতে, ভেসে যেতে থাকে বুড়োর মুখ’, ইনাম তখন তেতো গলায় প্রশ্ন রাখে, ‘এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ... ইনাম যেন বলছে, ‘এ্যাহন কান্দো ক্যা, আগে ভাইবে কাজ করলি তো আর কানতি হত না।’ এই গল্পে দেশভাগ নীরবভাবে প্রকাশিত হলেও তা আমাদের কঠিন জীবনের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। যা একজন হাসান আজিজুল হকের পক্ষেই সম্ভব।
‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পে প্রতীকী শিল্প-কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে। ইনাম, সুহাস আর ফেকু--এই তিন সহচরকে নিয়ে গল্পের শুরু। তাদের কথাবার্তায় জীবনধারণে বিচিত্র রূপ ফুটে ওঠে। বেকার তিন সহচর নানা অপকর্মে জীবন কাটায়। রাতে তারা এক জায়গায় যায়। সেখানে শীতল হওয়ার হাতছানি আছে। এক বুড়ো তার স্ত্রী ও আত্মজা রুকু বাড়িতে থাকে। রুকুর দেহবিক্রি করার টাকায় বুড়োর দিন কাটে। বুড়ো তাতে সহযোগিতা করে সত্য; কিন্তু করবী গাছের বিষফল খেয়ে জীবনের অবসানও কামনা করে।
হাসান আজিজুল হকের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, হাসান আজিজুল হক বিশিষ্ট তার শিল্পসাধ্যের জন্য। আমাদের সমাজের নিচের তলার মানুষ কীভাবে মার খায়, মার খেয়ে মরতে মরতেও কীভাবে মাথা তোলে, সমাজ-সচেতন শিল্পীরূপে সেই জিনিসটি তিনি ব্যাপকভাবে তাঁর গল্পে তুলে ধরেছেন।
তাঁর গল্পে প্রক্রিয়ায় সংঘাত ও দ্বন্দ্বগুলি খুবই স্পষ্ট; কখনো কখনো ভয়ঙ্কররূপে পরিস্ফুট। কিন্তু ভাষা-শিল্পের প্রচ- এক কাব্য সংঘাত সৃষ্টির মাধ্যমে এ ভয়ঙ্করের রূপ তিনি নির্মাণ করেন। তাতে জীবন যেমন ফুটে ওঠে, তেমনি জীবন চাপা পড়ে যায়। বৈশাখের পুঞ্জমেঘের কালো সন্ধ্যায় মেঘের গর্জন যেমন বৃষ্টি আনে, আবার বৃষ্টিকে তাড়িয়েও দেয়--অনেকটা সেই রকম। বাংলাদেশের বাংলা ছোটগল্পের ধারায় এ গল্পটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা, বিষয়বিন্যাস ও শিল্পরীতির অনন্য প্রকাশ ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পটি।